বিভিন্ন প্রকার সালাত

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম শিক্ষা - ইবাদাত | NCTB BOOK

সালাতুল বিতর

‘বিতর’ আরবি শব্দ। এর অর্থ বেজোড়। এ সালাত তিন রাকআত বিধায় এটিকে বিতর বলা হয়। এশার সালাতের পর তিন রাকাআত বিতর সালাত আদায় করা ওয়াজিব।

বিতর সালাত পড়ার নিয়ম

অন্যান্য ফরয সালাতের ন্যায় দুই রাকআত সালাত পড়ে তাশাহহুদ পড়তে হয়। এরপর তৃতীয় রাকআতেরে জন্য দাড়িয়ে সূরা ফাতিহার পর কোনো সূরা বা আয়াত পড়তে হয়। কিরাআত শেষ করার পর ‘আল্লাহু আকবার' বলে দু'হাত কান পর্যন্ত উঠাতে হয়। তারপর হাত বেঁধে চুপে চুপে দোয়া কুনুত পড়তে হয়। দোয়া কুনুত শেষে রুকুতে যেতে হয়। তারপর যথারীতি দুই সিজদার পর শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে বিতর সালাত সমাপ্ত করতে হয়।

দোয়া কুনুত

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমরা আপনার সাহায্য চাই, আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি, আপনার উপর আমরা ইমান এনেছি এবং, আপনার উপরই ভরসা করি, আর আপনার উত্তম প্রশংসা করি এবং আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, আপনার প্রতি অকৃতজ্ঞ হই না, যারা আপনার নাফরমানি করে, আমরা তাদের ত্যাগ করি এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করি। হে আল্লাহ! আমরা আপনারই ইবাদাত করি, আপনার উদ্দেশ্যেই সালাত পড়ি এবং আপনাকেই সিজদাহ করি। আপনার দিকেই ধাবিত হই এবং আপনার হুকুম পালনের জন্যই সদা সচেষ্ট থাকি। আমরা আপনার রহমতের আশা করি, আর আপনার শাস্তিকে ভয় পাই। নিঃসন্দেহে আপনার আযাব তো কাফেরদের সাথে সম্পৃক্ত।

জুমার সালাত

উম্মতে মুহাম্মাদির শ্রেষ্ঠ দিন হলো জুমার দিন। আর এই দিনের শ্রেষ্ঠ ইবাদাত হলো জুমার সালাত। জুমা শব্দের শাব্দিক অর্থ একত্রিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া, সমবেত হওয়া ইত্যাদি। শুক্রবারে সকল মুসলমান একত্রিত হয়ে যুহরের সালাতের পরিবর্তে জামাআত সহকারে যে সালাত আদায় করে তা হলো জুমার সালাত।

জুমার সালাতের গুরুত্ব

জুমার সালাত আদায় করা ফরয। কেউ যদি এই সালাতকে অস্বীকার করে তাহলে সে কাফির বলে পরিগণিত হবে। বিনা ওযরে কেউ যদি পর তিন জুমআহ বাদ দেয় তাহলে সে আল্লাহর কাছে মুনাফিক হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এই সালাতের অনেক ফযিলত রয়েছে। সালাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন,

অর্থ: ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন সালাতের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো, এটি তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি করো।' (সুরা জুমু'আ, আয়াত-৯)

জুমার দিনের তাৎপর্য প্রসঙ্গে মহানবি (সা.) বলেন, ‘সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিনই সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। এই দিনেই আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়েছিল। এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দুনিয়ায় পাঠানো হয় এবং এই দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।' (বুখারি) জুমার দিনে দোয়া কবুলের সম্ভাবনা বেশি। হযরত ফাতিমা (রা.) শুক্রবার দিনের শেষ ভাগে আসরের পর কাজকর্ম ছেড়ে আল্লাহর যিকর ও দোয়ায় শামিল হতেন। এদিনে আসর হতে মাগরিব পর্যন্ত সময়ে দোয়া কবুল হওয়ার অধিক সম্ভবনা রয়েছে।

জুমার সালাত আদায়ের নিয়ম

ইসলামে জুমার সালাত আদায়ের প্রতি খুবই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেমন – মহানবি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে পর পর তিন জুমার সালাত পরিত্যাগ করে, তার অন্তরে মোহর মেরে দেওয়া হয় এবং তার অন্তরকে মুনাফিকের অন্তরে পরিণত করে দেওয়া হয় (তিরমিযি)।

জুমার দিনে প্রথমে মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাআত তাহিয়্যাতুল অযু ও দুই রাকাআত দুখুলুল মসজিদ নফল সালাত আদায় করে চার রাকাআত কাবলাল জুমা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আদায় করতে হয়। এর পর ইমাম সাহেব মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে সময় উপযোগী খুতবা (ভাষণ) প্রদান করেন। মুসল্লিদের জন্য এই খুতবা শোনা ওয়াজিব। এই সময় কথা বলা নিষেধ। খুতবা শেষে ইমামের পিছনে দুই রাকাআত ফরয সালাত আদায় করতে হয়। কোনো কারণে জুমার সালাতে শরিক হতে না পারলে যুহরের সালাত আদায় করতে হয় ।

জুমার দিনের আদব

১. জুমার দিনে ইবাদাতের নিয়তে গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করা।

২. মসজিদে যাওয়ার পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করা।

৩. নখ কাটা।

৪. সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করা।

৫. জুমা দিবসে বেশি করে দরুদ পড়া।

সালাতুল জানাযা

জানাযা শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ হলো খাট বা খাটিয়া, খাটিয়ার উপর দাফন কাফনের জন্য রক্ষিত লাশ। আর সালাতুল জানাযা হলো এক বিশেষ সালাত যা মৃত মুসলমানকে কবর দেওয়ার আগে অনুষ্ঠিত হয়। শরিয়তের দৃষ্টিতে জানাযার সালাত হলো ‘ফরযে কেফায়া’। সমাজের কিছুসংখ্যক লোক আদায় করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। কিন্তু কেউ আদায় না করলে সবাই গুনাহগার হবে। এই সালাতের মধ্যে রুকু ও সেজদা করার বিধান নেই। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া জানাযার সালাত বসে আদায় করার সুযোগ নেই।

জানাযা সালাতের ফরয ২টি

১.

২. দণ্ডায়মান হয়ে সালাত আদায় করা।

জানাযা সালাতের ওয়াজিব ১টি

১. তাকবিরের পর ডানে ও বামে দুবার সালাম বলে সালাত শেষ করা।

জানাযা সালাতে সুন্নত ৩টি

১. হামদ ও সানা পড়া।

২. দরুদ শরিফ পড়া।

৩. মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা।

জানাযা সালাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

জানাযা সালাত মূলত মৃত ব্যক্তির প্রতি জীবিতদের পক্ষ থেকে বিশেষ দোয়া ইসলামি শরিয়তে জানাযা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। জানাযা সালাতে মৃত-জীবিত, উপস্থিত, অনুপস্থিত নারী-পুরুষ সবাইকে দোয়ার মধ্যে শামিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা মৃত ব্যক্তির জানাযার সালাত আদায় করবে, তখন তার জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করবে।' (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ) জানাযা সালাতে শুধু মৃত ব্যক্তি উপকৃত হয় না বরং জানাযায় অংশগ্রহণকারী সকলে উপকৃত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জানাযার সালাত আদায় করবে তার জন্য এক কিরাত (অসীম সওয়াব) আর যে ব্যক্তি দাফন কার্য সম্পাদন হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করবে তার জন্য দুই কিরাত (অসীম সওয়াব) রয়েছে।' (তিরমিযি) উল্লেখ্য, একেকটি কিরাত হলো উহুদ পাহাড় পরিমাণ। সুতরাং আমরা জানাযা সালাত আদায় করে অসীম সওয়াব লাভের চেষ্টা করব।

 

সালাতুল জানাযা আদায়ের নিয়ম

মৃত ব্যক্তিকে কিবলার দিকে মুখ রেখে ইমাম বুক বরাবর দাঁড়াবে। তারপর মনে মনে নিয়ত করতে হবে। প্রথম তাকবির বলে দুই হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে হাত বাঁধবে। অতঃপর সানা পড়বে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ‘ওয়া তা‘আলা জাদ্দুকা’ এর পর ‘ওয়া জাল্লা সানা উকা' বাক্যটি পড়া হয়। সানা শেষ হলে হাত বাঁধা অবস্থায় দ্বিতীয় তাকবির বলে দরুদ শরিফ পড়বে।

এরপর আবার তৃতীয় তাকবির বলে নিম্নের দোয়াটি পড়বে।

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফির লিহাইয়্যিনা ওয়া মায়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ওয়া ছাগিরিনা ওয়া কাবিরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনসানা। আল্লাহুম্মা মান আহয়িয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলামি ওয়ামান তাওয়াফ্ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ্ ফাহু আলাল ইমান।

অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের জীবিত, আমাদের মৃত, আমাদের মধ্যে উপস্থিত ও অনুপস্থিত, আমাদের মধ্যে ছোট ও বড়, আমাদের মধ্যে নারী ও পুরুষ সকলকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের মধ্যে যাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবেন তাদেরকে ইসলামের উপর বাঁচিয়ে রাখুন এবং আপনি যাদেরকে মৃত্যু দেবেন, তাদেরকে ইমানের ওপর মৃত্যু দান করুন।

সালাতুল ঈদাইন

ঈদ আরবি শব্দ। এর অর্থ আনন্দ, খুশি, উৎসব ইত্যাদি। ঈদের দিন হলো মুসলমানদের জন্য এক আনন্দ ও উৎসবের দিন। এ প্রসঙ্গে মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জাতিরই উৎসবের দিন আছে। আর আমাদের উৎসব হলো ঈদ।' (বুখারি ও মুসলিম)

বছরে দুটি ঈদ। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদের দিন এলাকার মুসল্লিগণ একত্রে ঈদগাহে সমবেত হন এবং দুই রাকআত ঈদের সালাত আদায় করে। ঈদের দিন বিশ্বের সকল মুসলিম পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদগাহে গিয়ে ছোট-বড়, আমির-ফকির একই কাতারে দাঁড়িয়ে এই বিশেষ ইবাদাত পালন করে থাকেন।

ঈদের সালাত আদায়ের নিয়ম

ঈদের দিন সূর্যোদয়ের পর থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের সালাত আদায় করা যায়। প্রথমে কাতার করে নিয়ত করবে। তাকবিরে তাহরিমা বলে হাত বাঁধবে। সানা পড়বে। তারপর ইমাম সাহেবের সাথে অতিরিক্ত তিনটি তাকবির বলবে। প্রত্যেক তাকবিরে কান পর্যন্ত হাত উঠবে। প্রথম দুই তাকবিরে হাত বাঁধবে না। তৃতীয় তাকবিরে অন্যান্য সালাতের মতো হাত বাঁধবে। ইমাম সাহেব স্বাভাবিক নিয়মে প্রথম রাকআত শেষ করে দ্বিতীয় রাকআতের রুকুতে যাওয়ার পূর্বে অতিরিক্ত তিনটি তাকবির বলবেন। মুসল্লিরাও তার সাথে তাকবির বলবে। তাকবিরে কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে ছেড়ে দেবেন, হাত বাঁধবে না। চতুর্থ তাকবিরে রুকুতে যাবে। এরপর স্বাভাবিক নিয়মে সালাত শেষ করবে। সালাত শেষে ইমাম সাহেব দুটি খুতবা দেবেন। প্রত্যেক মুসল্লি খুতবা শোনা ওয়াজিব। ঈদের মাঠে যাবার পথে ঈদুল আযহার তাকবির ঈদুল ফিতরের তাকবিরের অনুরূপ। আর ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের পদ্ধতি একই, শুধু নিয়তের বেলায় আলাদা নিয়ত করতে হবে।

ঈদের সালাতের সামাজিক প্রভাব

ঈদ মানে মহা আনন্দের আয়োজন। ঈদ আমাদের সমাজ সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ঈদ ধর্মীয় উৎসব হলেও এটি এখন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ঈদের দিন পরিবারের যে যেখানেই থাকুক না কেন, সবাই একত্র হয়ে থাকে। সকল আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার এটাই সর্বোত্তম সুযোগ হয়ে থাকে। ঈদের দিন মুসলমানরা একে অপরের খোঁজখবর নেয় ও একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে থাকে। ধনী-গরিব সবাই সকল প্রকার দুঃখ ভুলে আনন্দে থাকার চেষ্টা করে। সকল ভেদাভেদকে ভুলে সবাই একত্র হয়। ঈদের দিন পুরুষরা দলে দলে ঈদগাহে যায়। ছোট ছোট শিশুরা বাবা, ভাই ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে নতুন জামাকাপড় পড়ে ঈদগাহে যায়। সবার মধ্যে এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়। জামাআতবদ্ধ হয়ে সবাই নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে। ঈদগাহে প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার সকলের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ পায় সবাই। এর মধ্যে দিয়ে সকলের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি হয়। গরিব ও অসহায়েরা বিভিন্ন সমস্যার কথা উপস্থিত মুসল্লিদের বলার সুযোগ পায় ও প্রয়োজনীয় সাহায্য পেয়ে থাকে। ঈদের দিন সবাই আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে যায়। কুশল বিনিময় করে থাকে। এর মধ্যে দিয়ে আত্মীয়ের বন্ধন দৃঢ় হয়। ঈদের দিন আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের বাসায় একে অপরে খাওয়া-দাওয়া করে থাকে। যার মধ্যে দিয়ে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় ও মজবুত হয়।

 

সালাতুত তারাবিহ

তারাবিহ আরবি শব্দ। এর অর্থ বিশ্রাম করা, আরাম করা। শরিয়তের পরিভাষায় মাহে রমযান মাসে এশার সালাতের পর অতিরিক্ত ২০ রাকআত সুন্নত সালাতকে ‘সালাতুত তারাবিহ' বলা হয়। এ সালাতকে তারাবিহ নাম রাখা হয়েছে এ কারণে যে, এতে প্রতি চার রাকআত অন্তর কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেওয়া হয়। এ সালাত সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। নবি করিম (সা.) নিজে এ সালাত আদায় করেছেন ও সাহাবিগণকে আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তারাবি-এর সালাত জামাআতে আদায় করা সুন্নত।

তারাবিহর সালাত আদায়ের নিয়ম

রমযান মাসে এশার চার রাকআত ফরয ও দুই রাকআত সুন্নতের পর বিতর নামাযের পূর্বে তারাবিহের নিয়তে দুই রাকআত দুই রাকাআত করে মোট বিশ রাকআত সালাত আদায় করতে হয়। প্রতি চার রাকআত পর পর বিশ্রাম নিতে হয়। তখন বিভিন্ন তাসবিহ পড়া যায়। এসময় নিম্নের দোয়াটিও পড়া যায়:

উচ্চারণ: সুবহানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি সুবহানাযিল ইযযাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল হাইবাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়াই ওয়াল জাবারুত। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাযি লা-ইয়ানামু ওয়ালাইয়ামুতু আবাদান আবাদা। সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়ারাব্বুল মালাইকাতি ওয়ার রূহ।

তারাবিহের সালাত শেষ করে বিতরের সালাত রমযান মাসে জামাআতে আদায় করার বিধান রয়েছে।

তারাবিহ সালাতের গুরুত্ব ও ফজিলত

মাহে রমযানে তারাবিহ নামায আদায় করা অত্যন্ত সাওয়াবের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: মহান আল্লাহ তা—আলা মাহে রমযানের রোযা ফরয করেছেন এবং রাতে তারাবিহ নামাযের জন্য দণ্ডায়মান হওয়াকে পুণ্যের কাজ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

পবিত্র রমযান মাস রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস। পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় হলো রমযান মাস। সারা দিন সাওম (রোযা) পালনের পর বান্দা যখন ক্লান্ত শরীরে তারাবিহের বিশ রাকআত সালাত আদায় করে তখন আল্লাহ সে বান্দার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হন। বান্দার জন্য এমন সুযোগ বছরে মাত্র একমাসেই আসে। তাই আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আল্লাহর রহমত পেতে ব্রতী হন। এ প্রসঙ্গে নবি করিম (সা.) বলেন,

অর্থ: ‘যে ব্যক্তি ইমানের সাথে আখিরাতে প্রতিদানের আশায় রমযানের তারাবিহের সালাত আদায় করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন।' (বুখারি)

তারাবিহের সালাত ছোট ছোট সুরার মাধ্যমেও আদায় করা যায়। [আবার কুরআন খতমের মাধ্যমেও আদায় করা যায়। তারাবিহ-এর বিশ রাকাআতে পবিত্র কুরআন ধারাবাহিকভাবে তিলাওয়াত করে পূর্ণ কুরআন সমাপ্ত করাই নিয়ম। তবে মনে রাখতে হবে যে, সূরাগুলো স্পষ্ট, ধীরস্থির ও ছন্দের সাথে পড়তে হবে। রমযান মাসে তারাবিহের সালাত একত্রিত হয়ে জামাআতে আদায় করা উত্তম। এতে নামাযে ভুল হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। দীর্ঘ একটি মাস পরস্পরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়ের ফলে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা, মমত্ববোধ, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে, হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত হয়। অতএব, ফজিলতপূর্ণ এ নামায রমযানের পুণ্যময় সময়ে জামাআতের সাথে আদায় করা প্রত্যেক ইমানদার মুসলমানের জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর।

দলগত কাজ: তারাবিহ নামায জামাআতে আদায় করলে ভুল কম হয়-এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা করবে।

 

মাসবুকের সালাত

যে মুক্তাদি ইমামের সাথে সালাতের প্রথম রাকআত থেকে পায় নি, তাকে মাসবুক (পিছে পড়া) বলে। মাসবুক ব্যক্তি জামাআতে সালাত আদায় করতে গিয়ে ইমামকে যে অবস্থায় পাবে, সে অবস্থাতেই নিয়ত করে নামাযে অংশগ্রণ করবে। তারপর ইমামের সাথে সে নামায পড়তে থাকবে এবং যথারীতি রুকু সিজদাহ করে তাশাহহুদ পাঠের জন্য শেষ বৈঠকে বসে যাবে এবং ‘আব্দুহু ওয়া রাসুলুহু’ পযর্ন্ত পড়ে অপেক্ষা করবে। ইমাম সালাম ফিরালে মাসবুক ব্যক্তি সালাম না ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং ছুটে যাওয়া রাকআতগুলো যথারীতি আদায় করবে। অবশিষ্ট সালাতে তার নিজের ভুল হলে সাহু সিজদাহও করতে হবে।

প্রথমে কিরাআতওয়ালা রাকআত অর্থাৎ সূরা ফাতিহার সঙ্গে অন্য সূরা মিলানো রাকআত এবং পরে কিরাআতবিহীন শুধু সূরা ফাতিহাওয়ালা রাকআত পড়বে। তারপর শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ, দরূদ, দোয়া মাসুরা পড়ে সালামের মাধ্যমে সালাত শেষ করবে।

রুকুসহ ইমামের সথে যে কয় রাকআত পাওয়া যায় তা আদায় হয়ে যায়। রুকুর পর ইমামের পেছনে ইক্তেদা বা নামাযে দাঁড়ালে ঐ রাকআত মাসবুককে আদায় করতে হবে।

মুক্তাদির সালাত এক, দুই, তিন, চার রাকআত ছুটে গেলে, তা আদায়ে কিছুটা তারতম্য রয়েছে।

মুক্তাদি ইমামের পেছনে ইক্তেদা করার পর যদি এক রাকআত ছুটে যায়, তবে ইমামের সালাম ফেরানোর পর দাঁড়িয়ে যাবে এবং ছুটে যাওয়া এক রাকআত সূরা ফাতিহার সঙ্গে অন্য সূরা মিলিয়ে আদায় করে নেবে।

দুই রাকআত ছুটে গেলে ইমামের সালাম ফেরানোর পর মুক্তাদি দাঁড়িয়ে যাবে এবং ছুটে যাওয়া দুই রাকআত যথানিয়মে আদায় করবে, যেভাবে ফজরের দুই রাকআত ফরয সালাত একাকী আদায় করা হয়।

তিন রাকআত ছুটে গেলে ইমামের সালাম ফেরানোর পর মুক্তাদি দাঁড়িয়ে যাবে। এক রাকআত সূরা ফাতিহার সঙ্গে অন্য সূরা মিলিয়ে আদায় করে প্রথম বৈঠক করবে। এ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ার পর আবার দাঁড়িয়ে যাবে এবং বাকি দুই রাকআতের প্রথম রাকআতে সূরা ফাতিহার সঙ্গে অন্য সূরা মিলিয়ে আদায় করবে এবং পরের রাকআতে শুধু সূরা ফাতিহা পড়বে । এরপর শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ, দরূদ, দোয়া মাছুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে সালাত শেষ করবে।

চার রাকআত ছুটে গেলে অর্থাৎ মুক্তাদি ইমামকে শেষ বৈঠকে পেলে ইমামের সালাম ফেরানোর পর মুক্তাদি দাঁড়িয়ে যাবে। এরপর সে একাকী চার রাকআত নামায পড়লে যেভাবে পড়ত, ঠিক সেভাবে চার রাকআত নামায আদায় করবে।

চার, তিন, দুই রাকআত বিশিষ্ট নামাযে মুক্তাদি ইমামকে শেষ বৈঠকে পেলে ইমামের সালাম ফেরানোর পর মুক্তাদি দাঁড়িয়ে যাবে। যথানিয়মে ছুটে যাওয়া রাকআতগুলো এমনভাবে আদায় করে নেবে, যেভাবে একজন মুসল্লি একাকী চার, তিন, দুই রাকআত বিশিষ্ট সালাত আদায় করে থাকে।

দলগত কাজ: কোনো একজন শিক্ষার্থী জোহরের নামায আদায় করতে মসজিদে গিয়ে ইমামের সাথে এক রাকআত পেয়েছে। অবশিষ্ট নামায কীভাবে আদায় করবে? শিক্ষার্থীরা দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা করবে।

 

রুগ্ণ ব্যক্তির সালাত

দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ফরয। নির্ধারিত ওযর ব্যতীত সালাত পরিত্যাগ করা যাবে না। রুগ্‌ণ ব্যক্তি যথানিয়মে সালাত আদায় করতে না পারলে, তার জন্য ইসলামে সহজ নিয়মের অনুমোদন রয়েছে। রোগীর সেই সহজ নিয়মে সালাত আদায়কে রুগ্ণ ব্যক্তির সালাত বলে।

রুগ্‌ণ ব্যক্তির সালাত আদায়ের নিয়ম

রুগ্ণ ব্যক্তির জন্য জ্ঞান থাকা পর্যন্ত সালাত আদায় করা বাধ্যতামূলক। রোগ যত কঠিন হোক না কেন, সম্পূর্ণরূপে অপারগ না হলে সালাত ত্যাগ করা যাবে না। যথাসম্ভব ওয়াক্তের মধ্যেই নামায আদায় করতে হবে। নামাযের সমুদয় আরকান-আহকাম যথাযথভাবে আদায় করতে সামর্থ্য না হলে ইশারায় হলেও ওয়াক্তের মধ্যেই নামায আদায় করতে হবে।

রোগীর দাঁড়াতে কষ্ট হলে বসে রুকু-সিজদাহর সাথে সালাত আদায় করবে। রুকু-সিজদাহ করতে অক্ষম হলে বসে ইশারায় সালাত আদায় করবে। রুগ্ণ ব্যক্তিকে বসার সময় সালাতের অবস্থায় বসতে হবে। যদি রোগী এতই দুর্বল হয় যে বসে থাকা সম্ভব নয়, তবে কিবলার দিকে পা দুটি রাখতে হবে। পা সোজা না রেখে হাঁটু উঁচু করে রাখতে হবে এবং মাথার নিচের বালিশ বা এ-জাতীয় কিছু জিনিস রেখে মাথা একটু উঁচু রাখতে হবে। শুয়ে ইশারায় রুকু ও সিজদাহ করবে অথবা উত্তর দিকে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে এবং কিবলার দিকে মুখ রেখে ইশারায় সালাত আদায় করবে। যদি এভাবেও সালাত আদায় করা সম্ভব না হয়, তবে যেভাবে সম্ভব সেভাবে সালাত আদায় করতে হবে।

অপারগ অবস্থায় বা কেউ বেহুঁশ হয়ে পড়লে যদি চব্বিশ ঘণ্টা সময় অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বা তার চেয়ে কম সময় অতিক্রান্ত হয়, তাহলে সক্ষম হওয়ার পর রুগ্ণ ব্যক্তিকে ধারাবাহিকভাবে কাযা করতে হবে। যদি পাঁচ/ ছয় ওয়াক্তের বেশি সময় অতিবাহিত হয়, তবে আর ধারাবাহিকভাবে কাযা করতে হবে না। এ নামায আদায় না করতে পারার জন্য মহান আল্লাহর নিকট তওবা ও ক্ষমা প্রাথর্না করবে।

নামাযরত অবস্থায় কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে, দাঁড়িয়ে নামায পড়তে না পারলে বসে পড়তে হবে, বসে না পারলে শুয়ে বা ইশারা করে বাকি নামায আদায় করতে হবে।

দলগত কাজ: রুগ্ণ ব্যক্তির নামায আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিতে আলোচনা করবে।

 

মুসাফিরের সালাত

‘মুসাফির’ আরবি শব্দ। এর অর্থ সফরকারী। কোনো ব্যক্তি তার অবস্থানস্থল থেকে ৪৮ মাইল তথা ৭৮ কিলোমিটার দূরে সফর করার নিয়তে বের হয়ে নিজ শহর বা গ্রাম পেরিয়ে গেলেই তিনি মুসাফির হয়ে যান। আর এ অবস্থায় গন্তব্যস্থলে কমপক্ষে ১৫ দিন অবস্থান করার নিয়ত না করা পর্যন্ত মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন। মানুষের জীবনে সফর কিংবা ভ্রমণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ যখন নিজের আবাসস্থলে থাকে, তখন পূর্ণাঙ্গ সালাত আদায় করতে হয়। কিন্তু ভ্রমণে বা সফরে মুসাফির অবস্থায় যোহর, আসর ও এশার ফরজ সালাত কসর করতে হয়। ‘কসর’-এর অর্থ হলো কম করা বা সংক্ষেপ করা। কসর আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক ধরনের সুবিধা। শরিয়াত নির্ধারিত দূরত্বে সফর করা কালে সালাত সংক্ষেপ করা ইসলামের বিধান। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যখন জমিনে সফর করবে, তখন তোমাদের জন্য সালাতের কসর করায় কোনো দোষ নেই।' (সুরা নিসা, আয়াত: ১০১)

মুসাফিরের সালাত আদায়ের পদ্ধতি

মুসাফির ব্যক্তি চার রাকাআত বিশিষ্ট যোহর, আসর ও এশার ফরয সালাত দুই রাকাআত পড়বেন। কসর শুধু চার রাকাআত বিশিষ্ট ফরয সালাতেই হয়ে থাকে। অতএব, মাগরিব, ফজর এবং সুন্নত ও বিতরের সালাতে কোনো কসর নেই। আর এইভাবে সংক্ষেপে সালাত আদায়ের মধ্যেই আল্লাহ তা'আলা কল্যাণ রেখেছেন। মুসাফির চার রাকাআত বিশিষ্ট ফরয সালাত একাকী পড়লে বা মুসাফির ইমামের পেছনে আদায় করলে, কসর করবে। এ ক্ষেত্রে পূর্ণ নামাজ পড়া ঠিক নয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নবির মুখে সালাতকে মুকিম অবস্থায় চার রাকাআত ও সফর অবস্থায় দুই রাকাআত ফরয করেছেন।' (মুসলিম) মুসাফির ব্যক্তি সফর অবস্থায় ইচ্ছাকৃত চার রাকাআত সালাত পূর্ণ করবে না। কিন্তু মুকিম ইমামের পেছনে ইকতিদা করলে ইমামের অনুসরণ করে পূর্ণ সালাত আদায় করবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মুসাফির যদি মুকিমদের সঙ্গে সালাতে শরিক হয়, তবে সে যেন তাদের মতো চার রাকাআত সালাত পড়ে।' (ইবনে আবি শাইবা) মুসাফির ইমামতি করলে মুক্তাদিদের আগেই বলে দেবে যে সে মুসাফির এবং দুই রাকাআত পড়ে সালাম ফিরাবে আর মুকিম মুক্তাদিগণ দাঁড়িয়ে বাকি দুই রাকাআত সালাত আদায় করে নেবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সফর অবস্থায় সর্বদা সালাত কসর করেছেন। মুসাফির ব্যক্তির জন্য চলন্ত অবস্থায় সুন্নত না পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে স্বাভাবিক ও স্থির অবস্থায় সুন্নত সালাত আদায় করবে।

সালাতের নিষিদ্ধ সময়

ইসলাম সময় ব্যবস্থাপনার ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে। ইসলামে অনেক ইবাদাত ও আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে যা সরাসরি সময়ের সাথে সম্পর্কিত এবং সেগুলো নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই পালন করতে হয়। ইসলামের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি এবং অপরিহার্য ইবাদাত-সালাত আদায়ের জন্যও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। মহানবি (সা.) এর হাদিসে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায়ের উত্তম সময় সম্পর্কে যেমন নির্দেশনা রয়েছে তেমনি সালাতের নিষিদ্ধ সময় সম্পর্কেও নির্দেশনা রয়েছে। সালাতের নিষিদ্ধ সময় তিনটি। আর তা হলো—

১. ঠিক সূর্যোদয়ের সময়; 

২. ঠিক দ্বিপ্রহরের সময়; এবং 

৩. সূর্যাস্তের সময়।

এ সময়গুলোতে সাধারণত সালাত আদায় করা নিষেধ। তবে কোনো কারণে কেউ যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঐ দিনের আসরের সালাত আদায় করতে না পারে তবে তা আদায় করা যাবে কিন্তু মাকরূহ হবে। এ নিষিদ্ধ সময় প্রসঙ্গে সাহাবি উকবা ইবনে আমের জুহানী (রা.) বলেন, ‘তিনটি সময়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সালাত আদায় করতে এবং মৃতদের দাফন করতে নিষেধ করতেন। সূর্য উদয়ের সময়;যতক্ষণ না তা পুরোপুরি উঁচু হয়ে যায়। সূর্য মধ্যাকাশে অবস্থানের সময় থেকে শুরু করে তা পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া পর্যন্ত। এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তা হলুদাভ হওয়া থেকে শুরু করে যতক্ষণ না তা পুরোপুরি অস্ত যায়।' (মুসলিম)

সাহু সিজদাহ

সাহু শব্দের অর্থ হলো ভুলে যাওয়া। সাহু সিজদাহ অর্থ ভুল সংশোধনমূলক সিজদাহ। সালাতের কার্যক্রমে ভুলক্রমে কোন ওয়াজিব বাদ পড়লে যেমন রাকাআত সংখ্যা ভুলে কম-বেশি হয়ে গেলে তা সংশোধনের জন্য সালাতের শেষ বৈঠকে দুটি সিজদাহ দেওয়া ওয়াজিব। শরিয়তের দৃষ্টিতে এই রকম সিজদাই হলো সাজদাতুস সাহবু বা সাহু সিজদাহ। রাসুল (সা.) সালাতের ভুল সংশোধনের জন্য এই রকম আমল করেছেন যা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

সাহু সিজদাহ ওয়াজিব হওয়ার কারণ

১. সালাতের কোনো ওয়াজিব ভুলক্রমে ছুটে গেলে। 

২. কোনো ওয়াজিব পুনরায় বা দুইবার আদায় করা হলে। 

৩. সালাতের কোনো ওয়াজিব যথাযথভাবে আদায় না করা যেমন রুকু থেকে সাজদাহ বিলম্বে আদায় করলে। 

8. ভুলক্রমে কোন ফরয দুইবার আদায় করা হলে 

৫. কোনো ওয়াজিব পরিবর্তন হলে। যেমন যে সালাতে ক্বিরাত প্রকাশ্যে পড়ার বিধান পড়া হয় সেই সালাতে গোপনে ক্বিরাত পড়া। অপরপক্ষে যে সালাতে ক্বিরাত গোপনে পড়া হয়, সেই সালাতে প্রকাশ্যে ক্বিরাত পড়া। 

৬. সালাতের ফরযসমূহ আদায় করতে গিয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষা না করা। যেমন কোনো ফরযকে এগিয়ে আনা আবার কোন ফরযকে পিছিয়ে দেওয়া।

সাহু সিজদাহ আদায়ের নিয়ম

সালাতের শেষ বৈঠকে তাশাহুদ তথা আত্তাহিয়্যাতু শুরু করে ‘আবদুহু ওয়ারাসুলুহু' পর্যন্ত পড়ে ডান দিকে সালাম ফিরাতে হয়। অতঃপর ‘আল্লাহু আকবর' বলে দু'টি সিজদাহ আদায় করতে হয়। উল্লেখ্য, সিজদাহ দুটিতে নিয়ম অনুযায়ী তাসবিহ পড়তে হয়। এরপর বসে যথানিয়মে তাশাহহুদ (আত্তাহিয়্যাতু), দরূদ শরিফ ও দোয়া মাসূরা পড়ে দুই দিকে সালাম ফিরিয়ে সালাত শেষ করতে হয়।

সালাত সংশ্লিষ্ট তাসবিহ ও দোয়াসমূহ

 

সালাতের প্রয়োজনীয় দোয়াসমূহ

সালাত আদায়ের সময় অনেকগুলো দোয়া এবং তাসবিহ পড়তে হয়। তার মধ্য থেকে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো। আমরা এইগুলো শিখব এবং সালাতে নির্দিষ্ট জায়গায় তা পাঠ করব।

১. নামাযের পূর্বপ্রস্তুতির দোয়া: ওযু করে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করার সময় আল্লাহ তা‘আলাকে উপস্থিত জেনে পড়তে হবে -

অর্থ: ‘আমি পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে আমার মুখমণ্ডল সেই সত্তার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছি বা নিবদ্ধ করলাম, যিনি আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন, আর আমি তাদের মধ্যে নেই যারা তাঁর সঙ্গে অন্যকে শরিক করে।' (সূরা আল-আনআম, আয়াত: ৭৯)

২. সালাতের নিয়ত: এরপর নিয়ত করতে হবে। ‘নিয়্যাত' আরবি শব্দ। এর অর্থ ইচ্ছা করা, সংকল্প করা ইত্যাদি। কোনো কিছু করার জন্য মনে মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকেই নিয়ত বলে। নির্দিষ্ট কোনো বাক্যের মাধ্যমে সালাতের নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা আবশ্যক নয়, মনে মনে নিয়ত করলেই হবে। তবে মনসংযোগের জন্য অনুচ্চ আওয়াজে মুখে আওড়ানো যেতে পারে।

৩. সানা: তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার' বলে হাত বাধার পর এই সানা পড়তে হবে।

উচ্চারণ: সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তা'আলা জাদ্দুকা ওয়া লা-ইলাহা গাইরুকা।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং প্রশংসা করছি, আপনার নাম বরকতময়, আপনার মর্যাদা অতি ঊর্ধ্বে। আপনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই।'

৪. তাকবিরে তাহরিমা

উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার

অর্থ: আল্লাহ সবচেয়ে বড়।

৫. রুকুর তাসবিহ

উচ্চারণ: সুবহানা রাব্বিয়্যাল আযীম

অর্থ: আমি আমার রবের পবিত্রতা ঘোষণা করছি।

৬. রুকু থেকে উঠার তাসবিহ

উচ্চারণ: রাব্বানা লাকাল হামদ

অর্থ: হে আমাদের রব! যাবতীয় প্রশংসা আপনারই জন্য

৭. রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানো অবস্থার তাসবিহ

উচ্চারণ: সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ

অর্থ: যে ব্যক্তি আল্লাহর তা‘আলার প্রশংসা করেন, আল্লাহ তা'আলা (ঐ ব্যক্তির প্রশংসা) শোনেন।

৮. সিজদাহর তাসবিহ

উচ্চারণ: সুবহানা রাব্বিয়াল আ'লা

অর্থ: পবিত্রতা ঘোষণা করছি আমার মহান রবের।

৯. তাশাহহুদ

উচ্চারণ: আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্সলাওয়াতু ওয়াত্তাইয়েবাতু, আস্সালামু আলাইকা আইয়ুহান্‌নাবিয়্যু ওয়া রহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ, আস্সালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস্ সলেহীন, আশ্হাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ।

অর্থ: ‘সমুদয় প্রশংসা, সব ইবাদাত ও সমস্ত পবিত্রতা আল্লাহর জন্য। হে নবি! আপনার উপর সালাম আর আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের উপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের উপর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসুল।’

আদর্শ জীবন গঠনে সালাতের ভূমিকা

ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে সালাত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। ইমানের পরই সালাতের স্থান। মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট বান্দার বিনয় ও অনুগত্য প্রকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো সালাত। সালাতের মাধ্যমেই আল্লাহর নিকট বান্দার চরম আনুগত্যের অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম বান্দার কাছে সালাতের হিসাব চাইবেন।

সালাত নিত্যপালনীয় একটি ফরয ইবাদাত হলেও আদর্শ জীবন গঠনে এর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রয়েছে। আদর্শ জীবন বিনির্মাণে অত্যাবশ্যকীয় গুণাবলি সালাত আদায়ের মাধমে অর্জন করা যায়। পাপাচার, অন্যায় ও অশ্লীলতামুক্ত আদর্শ জীবন গঠনে সালাত সহায়তা করে। সালাত সকল প্রকার পাপাচার ও খারাপ কাজ পরিহার করে সৎ পথে পরিচালিত করে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন-

অর্থ: ‘নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সূরা আল-‘আনকাবূত,আয়াত: 8৫)

সালাত আমাদের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। জামাআতে সালাত আদায়ের সময় সমাজের উচু-নিচু, ধনী- নির্ধন এবং সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ একত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাশাপাশি দাঁড়াতে হয়। এতে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয় ।

সালাত আমাদের সময়ানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধের শিক্ষা দেয়। সালাতে রুকু সিজদাহ যথানিয়মে করতে হয়। এতে নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলার শিক্ষা পাওয়া যায়। আর নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায়ের মাধ্যমে সকল কাজ সঠিক সময়ে করারও শিক্ষা পাওয়া যায়। নিয়মিত সালাত আদায়কারী সাধারণত কর্তব্য পালনে অবহেলা করে না ।

অত্যন্ত বিনীত ও নম্রভাবে একাগ্র চিত্তে সালাত আদায় করতে হয়। একাগ্রতাবিহীন সালাত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। সালাত আদায়ের সময় মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হয় মহান আল্লাহ তাকে দেখছেন। এভাবে সালাত আদায়ের মাধ্যমে অর্জিত বিনয় ও একাগ্রতা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োগের মাধ্যমে আদর্শ জীবন গঠন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আল্লাহর যে সকল বান্দা এভাবে বিনয়-নম্রতা ও বিনম্র- একাগ্রতা নিয়ে সালাত আদায় করে তাদের সফলতা অবশ্যাম্ভাবী। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন –

অর্থ: ‘অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছেন,যারা নিজেদের সালাতে বিনয় ও নম্র।' (সূরা মু'মিনূন, আয়াত: ১-২)

জামাআতে সালাত আদায় করলে মুসলিমগণ দৈনিক পাঁচবার একত্র হওয়ার সুযোগ পান। এ সময় একে অপরের খোঁজ-খবর নিতে পারেন। অসহায় ও দরিদ্রকে সাহায্য-সহযোগিতা করা যায়। এতে সকলের সাথে সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। এ রকম আরও অনেক উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জনে সালাত প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। তাই বলা যায় আদর্শ জীবন গঠনে সালাতের ভূমিকা অপরিসীম। আমরা নিয়মিত সঠিকভাবে সালাত আদায় করব এবং জীবনকে সুন্দর ও আদর্শময় করে গড়ে তুলব।

তাহলে এতক্ষণ আমরা সালাত সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম, শিখলাম। ষষ্ঠ শ্রেণিতেও আমরা সালাত সম্পর্কে জেনেছি। এখন তাহলে আমরা সালাত সম্পর্কিত আমাদের সকল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। কিভাবে জানো? এবার শিক্ষকের সহায়তায় তোমরা সব বন্ধুরা মিলে একটি ডেমোনস্ট্রেশন বা ডিসপ্লে /মহড়ার আয়োজন করবে। সেখানে শিক্ষকের উপস্থিতিতে কীভাবে সঠিক নিয়মে সালাত আদায় করতে হয় তা তোমরা প্রদর্শন করবে।

Content added By
Promotion